আজকের শরীয়তপুর জেলা মুক্তিযুদ্বের সময় ছিল মাদারীপুর মহাকুমার অর্ন্তগত । ভেদেরগঞ্জ, নড়িয়া, গোসাইরহাট, জাজিরা ও পালং থানা নিয়ে মাদারীপুর মহাকুমার এ অঞ্চলকে বলা হতো পূর্ব মাদারীপুর । যা পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে এ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় আর একটি মহাকুমা । ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ হাজী শরীয়তুল্ল্যাহর নামানুসারে এ নবগঠিত মহাকুমাটির নামকরন করা হয় শরীয়তপুর । ১৯৮৬ সালে দেশের সকল মহাকুমাকে জেলায় উন্নীত করার প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয় শরীয়তপুর জেলায় । মুক্তিযুদ্বের সময় মাদারীপুর মহাকুমা মুক্ত হয় ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ কিন্তু পূর্ব মাদারীপুর অঞ্চল বর্তমান শরীয়তপুর জেলা মুক্ত হয় ১৫ অক্টোবর ১৯৭১ । ১৫ অক্টোবরের পর শরীয়তপুর জেলা অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব মাদারীপুর অঞ্চলে পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের কোন উপস্থিতি বা কার্যক্রম ছিল না । আর শরীযতপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা মুক্ত হয় ২৩ জুন’৭১ । নড়িয়া থানার শান্তি কমিটির সভাপতি ও তৎকালীন নড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী আহম্মেদ মুন্সীর বাড়ী ২৩ জুন’৭১ আক্রমন করা হয় এবং আলী মুন্সী ও ডিআই ওয়ান সহ তিন জন নিহত হয় । এরপর নড়িয়া থানা এলাকায় পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের কোন উপস্থিতি বা কার্যক্রম ছিল না ।
মাদারীপুর মহাকুমার তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য ডাঃ আবুল কাশেম, এ্যাডঃ আবিদুর রেজা খান, ফনিভূষন মজুমদার, হাসমত আলী খান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, আলী আহাম্মদ খান ও আমিনুল ইসলাম দানেশ একটি সভায় মাদারীপুর মহাকুমাকে মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার হিসেবে ঘোষনা করেন । এ হেডকোয়ার্টারে কর্ণেল (অবঃ) শওকত আলী (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ত্ব গ্রহণ করেন । মুক্তিযুদ্বে কৃতিত্ত্বের জন্য সরকার তাঁকে পরবর্তীতে বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করেন । এ সময় তাঁর সহযোগি হিসেবে স্টুয়ার্ড মুজিবকে দায়িত্ত্ব দেওয়া হয় । মাদারীপুর মহাকুমাকে যুদ্বের কৌশল হিসেবে মাদারীপুর ও পূর্ব মাদারীপুর দুই ভাগে ভাগ করা হয় । নড়িয়া-পালং থানা এলাকার এরিয়া কমান্ডার ইউনূছ আলী খান মিতালী, পরবর্তীতে নড়িয়া-পালং থানা এলাকায় এরিয়া কমান্ডার মাস্টার দিদারুল ইসলামকে দায়িত্ত্ব দেয়া হয় । এছাড়া নড়িয়া থানা কমান্ডার এস, এম, কামাল উদ্দিন মন্টুকে দায়িত্ত্ব দেয়া হয় । এদিগে রাজনৈতিক কারণে গঠিত মুজিব বাহিনীতে লেঃ কর্ণেল মরহুম আলমগীর হাওলাদার, মিজানুর রহমান রাড়ী (বাবুল রাড়ী) ও সফিকুর রহমান (বাচ্চু) কে নড়িয়া থানার দায়িত্ত্ব দেয়া হয় ।
১৯৭১ সালের ২২ জুন নড়িয়া থানা আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয় । ইউনূছ আলী খান মিতালীর নেতৃত্ত্বে এ আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয় । তার সাথে ছিলেন এস এম কামাল উদ্দিন মন্টু, রওশন আলী ও জেমস বাবুল সহ আরো কয়েকজন । ২৩ জুন’৭১ নড়িয়া থানা শান্তি কমিটির সভাপতি এবং নড়িয়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আলী আহাম্মেদ মুন্সীর বাড়ী ও ওয়্যারলেস সেট উদ্বারের সিদ্বা্ন্ত নেওয়া হয় । থানার ভেতরে হাফেজ আঃ রশিদ এবং আঃ জলিল বেপারীরা রাতে থাকেন । রেকি করার দায়িত্ত্ব থানার ভেতরে হাফেজ আলাউদ্দিন এবং থানার বাহিরে ইউনূস আলী, জেমস বাবুল, এস এম কামাল উদ্দিন মন্টু ও রওশন আলী । ২৩ জুন ডাঃ কাঞ্চনকে দায়িত্ত্ব দেয়া আলী মুন্সীর বাড়ীর । জেমস বাবুল ওয়্যারলেস সেট এবং ইউনূছ আলী খান মিতালীর থানা । এই মোতাবেক ২৩ জুন’৭১ আক্রমন করা হলো একই সময় । পরিকল্পনা অনুযায়ী থানার দক্ষিন পূর্ব কোন এবং পশ্চিম দিকে মুক্তিযোদ্বারা অবস্থান নেয় । আক্রমন করার পূর্বে শত্রু বাহিনীরদেরকে আত্মসমর্পনের জন্য বলা হয় । কিন্তু তারা আত্মসমর্পন না করে পাল্টা গুলি ছোরে । শুরু হয় তুমুল যুদ্ব । এই যুদ্বে পাক দোসর, রাজাকারসহ ৭/৮ জন নিহত হয় । এখানে ৭টি রাইফেলসহ ৩৫০ রাউন্ড গুলি মুক্তিযোদ্বারা দখল করে নেয় । এই যুদ্বে আবদুল জলিল ও হাফেজ রশিদ শহীদ হয় । অপর দিকে ডাক্তার কাঞ্চন আলী তার সঙ্গীদের নিয়ে মুন্সী বাড়ী আক্রমন করে । সেখানে আলী মুন্সী ও ডিআই ওয়ান সহ তিনজন নিহত হয় । বাড়িটি মুক্তিযোদ্বাদের দখলে চলে আসে । এরপর নড়িয়া থানা এলাকায় পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের কোন উপস্থিতি বা কার্যক্রম ছিল না ।
২২ মে’৭১ মাদারীপুর থেকে পাক সেনাবহিনী নড়িয়া বাসতলা মমিন আলী বেপারীর বাড়ী ও তাদের ঘরে থাকা এক যুবতী মেয়ে নাসিমা আক্তারকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলে পাকহানাদার বাহিনী । বর্তমানে নাসিমার কবরটি জাতীয়বীর ডেপুটি স্পীকার কর্ণেল (অবঃ) শওকত আলীর উদ্যেগে নড়িয়া পৌরসভার মেয়র মোঃ হায়দার আলী সংস্কার করে কবরটি পাকা করে দেয় । এছাড়া মোক্তারের চর শহর আলী ফকিরের বাড়ীসহ কয়েকটি বাড়ী নড়িয়া বাজারের সোলায়মান ঢালীর দোকান পুড়িয়ে ফেলে । এছাড়া ঘড়িষার বাজারের দোকানদার মৃত খলিলুর রহমান লাকুরিয়ার ছেলে বীরমুক্তিযোদ্বা আঃ রশিদ লাকুরিয়ার মুক্তিযুদ্বে যাওয়ার অভিযোগে এবং এক হিন্দু ব্যবসায়ীর দোকানে বঙ্গবন্ধু ছবি পাওয়ায় তাদের দোকানসহ আরো ৮/১০টি দোকান পুড়িয়ে দেয় । এছাড়া নড়িয়া থানার হিন্দু অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় আলবদর ও রাজাকার বাহিনী হত্যা, ধর্ষন ও ব্যাপক লুটতরাজ চালায় ।
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্বা মাষ্টার দিদারুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্বকালী নড়িয়া-পালং এলাকার এড়িয়া কমান্ডার
সম্পাদনায়ঃ জাকির হোসেন হাওলাদার, নাজির, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, নড়িয়া, শরীয়তপুর ।
তাং- ২৩/১২/২০১৩ খ্রিঃ ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস