নড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী দরবার শরীফ সৃরেশ্বর দরবার শরীফ।
এমন কিছু শব্দ আছে যা খুবই মিষ্টি মধুর। একবার শুনলে বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। এমন কিছু নাম আছে অতি হৃদয়গ্রাহী। অন্তরের সাঙ্গে মিশে থাকে সবসময়। প্রথমবার শ্রবণেই মনে হয় অতি পরিচিত। মনে হয় অনেক আগে এ নামটি শুনেছিলাম, হয়তো বাল্যকালে। নয়তো স্বপ্নে দেখেছি এ নাম। মনে হয় অতি পরিচিত একান্ত আপন নাম।
এমনই এক সাড়া জাগানো ছোট্ট আর মিষ্টি নাম 'সুরেশ্বর'। এক মহাপবিত্র গ্রামের নাম 'সুরেশ্বর'। দেশের মানুষের প্রেম-ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জড়িত হৃদয় স্পর্শী এ নাম। অন্তরের সঙ্গে মেশানো এ নাম আর ভুলবার নয়। যে নামে এত আকর্ষণ তার রূপ কেমন?
সে এক স্বপ্নীল ভুবন, স্বর্গীয় পরিবেশ। রূপসী বাংলার পদ্মানদীর তীরে পাখিডাকা ছায়াঘেরা নির্জন এক গ্রাম। ফুলের সুবাস, পাখির কাকলি, নদীর কুলকুল ধ্বনীতে মুখরিত পবিত্রতম স্থান 'সুরেশ্বর'। এ পবিত্র মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনের পাপতাপ কালিমা সবই যেন মুছে যায়। মনে হয় স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছি, নয়তো স্বর্গীয় কোন ভূমিতে।
'সুরেশ্বর' নামের সন্ধি- সুর+ঈশ্বর = 'সুরেশ্বর'। ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক অলিয়ে কামেল শামসুল ওলামা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ জান শরীফ শাহ্ রাঃ 'সুরেশ্বরী' নামেও সমধিক পরিচিত। ভক্ত ও মুরিদগণ তাঁকে 'বাবা সুরেশ্বরী' বা 'সুরেশ্বরী কেবলা কাবা' বলে সম্বোধন করেন এবং তাজিম ভক্তি শ্রদ্ধা জানান। সাধারণের কাছে তিনি হযরত সুরেশ্বরী নামে সর্বাধিক পরিচিত। 'সুরেশ্বরী' নামের পেছনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে।
আধ্যাত্মিক গণনের উজ্জ্বল সূর্য্য হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর পূর্ব্ব পুরুষগণ সুরেশ্বরের পার্শ্ববর্ত্তী ইছাপাশা গ্রামে তৎকালীন নওয়াবগণ কর্তৃক দানকৃত ৩৫০ বিঘা লাখেরাজ (নিষ্কর) সম্পত্তিতে অবস্থান করিতেন। পরবর্ত্তীতে তাঁহাদের অধঃস্তন পুরুষগণ সেখানকার গরীব মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সকল সম্পত্তি দান করিয়া রিক্ত হস্ত হইয়া বর্ত্তমান সুরেশ্বর ও ইছাপাশা গ্রামের মধ্যবর্ত্তী স্থানে বসবাস শুরু করেন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর পিতা কেবলার যে বসত ভূমি ছিল, জমিদারগণ তথায় প্রচুর পরিমাণে নিষ্কর ভূমি দান করেন। সেই সম্পত্তিতেই হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর পিতা কেবলা হযরত সূফী সাহেব রাঃ ফরিদপুর জেলার আদি সুদর্শন মসজিদ নির্মাণ করেন। তথায় পাঞ্জেগানা ও জুমার নামাজ নিয়মিত আদায় হত। অজুর সুবিধার্থে তথায় বিশাল আকারে দীঘি খনন, শান বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়। বর্ত্তমানে সেই আদি মসজিদ আর নেই। সেখানে নতুন ভাবে দো'তলা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
এই অঞ্চলে ১৯০৭-১০ খ্রীষ্টাব্দে সি.এস. জরিপ হয়। জরিপের সময় কোন জরুরী কারণে ইংরেজ সেটেলমেন্ট অফিসার জে.সি.জেক এই অঞ্চল পরিদর্শনে আসেন। মহান কামেল অলি আল্লাহ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত অবগত হন। তিনি জানতে পারলেন যে, হযরত সুরেশ্বরী রাঃ একজন আধ্যাত্মিক সূফী সাধক, মহা-পুরুষ। তিনি আধ্যাত্মিক সঙ্গীত ও সুর পছন্দ করেন। অনেকেই তাঁকে 'সুরের ঈশ্বর' বলে অভিহিত করেন। ইংরেজ সেটেলমেন্ট অফিসার আত্মিক ভাবে তাঁর নূরানী রূপ দর্শনের জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। তখন তিনি অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি গভীর ভাবে এই মহা-পুরুষের মহানুভবতা ও সার্ব্বিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর মুখ ম-লে স্বর্গীয় নূরানী আভা ও সৌম্য-সৌন্দর্য্য দর্শনে তিনি আনন্দ-বিস্ময়ে অভিভূত হন। সে সময়েই তিনি এই আধ্যাত্মিক মহা-পুরুষের সম্মানে উক্ত গ্রামের নাম 'সুরেশ্বর' বলে অভিহিত করেন। উক্ত জরিপেই সেই অঞ্চলকে 'সুরেশ্বর' মৌজা জে. এল. নং ৪৪৯ নামকরণ করা হয়। প্রকাশ থাকে যে, তখন এই মৌজা পালং থানা, মাদারীপুর মহকুমা, ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছিল।
পদ্মা বিধৌত দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফ বৃহত্তর ফরিদপুরের বর্ত্তমান শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার সুরেশ্বর গ্রামে অবস্থিত। বর্ত্তমানে পদ্মা নদী সুরেশ্বর দরবার শরীফ সংলগ্ন অবস্থিত হলেও পূর্ব্বে পদ্মা তীর হতে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। আরও পূর্ব্বে সুরেশ্বর ঢাকা জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলের খলিলাবাদ পরগনার অধীনে ছিল। তখন বিক্রমপুর নামেই সমধিক পরিচিত ছিল।
উত্তরে ধলেশ্বরী নদী, পূর্ব্বে মেঘনা নদী, পশ্চিমে পদ্মা ও চন্দ্র প্রতাপের কিয়দংশ। পদ্মা নদী বিক্রমপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তর বিক্রমপুর ও দক্ষিণ বিক্রমপুর দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে পদ্মার গতি পরিবর্ত্তিত হয়ে বিক্রমপুরের দক্ষিণ ভাগ ঢাকা জেলা হতে পৃথক হয়ে যায়। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ জুনের সরকারী বিজ্ঞাপন অনুসারে ঐ সনের ১ আগষ্ট হতে রাজনগর, জপসা, কোয়ারপুর, নড়িয়া, লোনসিংহ, কার্ত্তিকপুর, ফতেজঙ্গপুর, নগর, বিঝারী, পন্ডিতসার, কেদারপুর, মুলফৎগঞ্জ, পালং, পোড়াগাছা, কুড়াশি, পারগাও প্রভৃতি ৪৫৮ গ্রাম সহ দক্ষিণ বিক্রমপুর, বাকরগঞ্জ থানার শাসন সংক্রান্ত কার্য্য বাকরগঞ্জ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অধীনে ন্যস্ত করা হলেও কার্য্যতঃ তা হয়নি।
এখানকার অধিবাসীবৃন্দের তুমুল আন্দোলনের ফলে মুলফৎগঞ্জ সহ মাদারীপুর মহকুমা ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। পদ্মার যে শাখা উত্তর বাহিনী হয়ে বহর, বালিগা, সুবচনী, তালতলা প্রভৃতি স্থান দিয়ে ধলেশ্বরীর সাথে সম্মিলিত হয়েছে, তা আবার উত্তর বিক্রমপুরকে পূর্ব্ব বিক্রমপুর ও পশ্চিম বিক্রমপুর এই অংশে বিভক্ত করেছে।
সেই সময় নড়িয়া থানা ছিল না। এর নাম ছিল লোনসিংহ, তৎপর পালং থানা। বর্ত্তমানের নড়িয়া ও পালং থানা সেই সময়ে এক সঙ্গে পালং থানার অন্তর্গত ছিল। পরবর্ত্তীতে পালং ও নড়িয়া থানা ভাগ হয়ে যায়। তখন মহকুমা মাদারীপুর, আর জেলা ফরিদপুর।
বৃটিশ আমলে শাসন ব্যবস্থার সুবিধার্থে পদ্মা নদীর দক্ষিণ অঞ্চলটি ঢাকা জেলা হতে বিভক্ত করে ফরিদপুর জেলার আওতায় আনা হয়। পূর্ব্বেকার যে সকল কাগজ পত্র রয়েছে, তাতে এই অঞ্চল বিক্রমপুর ও খলিলাবাদ পরগনার অধীনে ঢাকা জেলার অন্তর্গত ছিল।
আল্লাহ তায়ালার এক অপূর্ব সৃষ্টি সুরেশ্বর। সর্বজন বিদিত যে পদ্মা নদীর পানি ঘোলাটে আর মেঘনার পানি নীলচে। তবে লক্ষণীয় যে এ দুটি নদীর পানি কখনো এক সঙ্গে মেশে না। আরও লক্ষণীয় যে, এ নদী দুটির সঙ্গমস্থল সুরেশ্বরের কাছেই। সুরেশ্বর পেরিয়ে একটু সামনে গেলে দেখা যায় এ দুটি নদীর ধারা মিলিত হওয়া সত্ত্বেও নদী দুটির পানির অবস্থানও রঙের ভিন্নতা। এ ছাড়া প্রকৃতির অন্যতম দান মিষ্টি ডাটা ও পদ্মার সুস্বাদু ইলিশের জন্য সুরেশ্বর বিখ্যাত।
হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ ছিলেন সুরের প্রেমিক। আল্লাহ্ প্রেম এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনে সুর বা সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক জড়িত। 'সুর' মনে ভাব জাগায়, অন্তরে প্রেম সৃষ্টি করে। সুরে আল্লাহ্, ফেরেশতা, মানুষ এমন কি প্রাণীকুল পর্যন্ত বিমোহিত হয়। সুতরাং এমন সুর কখনো বর্জনীয় হতে পারে না। যে সুরে ভাবের সৃষ্টি হয়, হৃদয়ে ঐশ্বরিক প্রেম জাগে সে সুর অবশ্যই কাম্য।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস